শাহনাজ রানু
১৪ নভেম্বর ২০২২
“মেয়ে, তুমি কি দুঃখ চেনো?”
– না, চিনি না।
জন্মের পর থেকে এখন অব্দি বিলাস করার মতো দুঃখ আমার নেই! প্রথম যেদিন বুঝলাম ঠিক তোমার মতো করে বড় আমি হচ্ছি না, ঠিক তোমার মতো স্বাধীন পাখনা আমার নেই, ঠিক তোমার মতো করে উদযাপিত হচ্ছে না আমার জীবনের প্রতিটি বাঁক, সেদিন বুঝেছি আমার কোন দুঃখ নেই। অথবা দুঃখের ঝাঁপি খুলে থিতু হবার মতো অভিলাস আমার নেই!
তবুও তুমি জানতে চাও আমি দুঃখ চিনি কিনা!
না, চিনি না!
বাড়ন্ত বৃক্ষকে বিশেষ শাসনে কি বানানো হয় জানো?- বনসাই। সুন্দর, পরিপাটি, নান্দনিক বনসাই। অপরিসীম পরিচর্যায় সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় বনসাই জীবন যাপন করে। বাইরে খোলা হাওয়ায় নিলেই মৃত্যু হয় তার। আমাদের জীবনটাও সেই বনসাই। সৌন্দর্য আর পরিচর্যায় কতো সুখী সুখী দেখায় আমাদের। আমরা ফরমের পুতুল, এমন জীবন ব্যবস্থা সাজানো আছে যে এর বাইরে গেলেই ছেঁটে ফেলা হয় ডালপালা!
না, তারপরও আমি কিন্তু দুঃখীদের নই!
– “মেয়ে, তুমি দুঃখ চেনো? চেনো না!তবে চিনবে কেমন করে এই আমাকে?”
– হুম তাই তো! তোমাকে চিনতে হলে আমার দুঃখ চিনতে হবে। দুঃখ, নানা বর্ণের দুঃখ।
কখনো দেখেছো হঠাৎ চেনা জগত উলোটপালোট হতে? দেখেছো অমানবিক অত্যাচারে মরে যেতে কোন তাজা প্রাণ? ধর্ষণে পঁচে যেতে দেখেছো আত্মা নামক অণির্বান কে? গলার ক্ষত ঢাকতে দেখেছো অপমানের ওড়না দিয়ে? প্রেমিকের চোখে লালসা, মিথ্যে অঙ্গীকার, বৈবাহিক জমিদার প্রথা, সন্তান প্রসবের যাতনা কেমন- জানো? অথবা তীলে তীলে নিভে যাওয়া কবিতার আগরবাতি?
না, চিনি না আমি কোন দুঃখ! তোমাকে চিনবার তাগিদও তাই নেই। প্রতিদিনের এই সুখ, এই বনসাই জীবন আমাকে কোন বটবৃক্ষ চিনতে উৎসাহিত করে না।
আমি কোন দুঃখ চিনি না!
চিনি না তোমাকেও!
(সমাপ্ত )
শিক্ষিত চাকুরিজীবী বলেই ডিভোর্স!
এমি জান্নাত, সাংবাদিক ও লেখক
চাকুরিজীবী মেয়েদের ডিভোর্স হলে একটা কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নানাভাবে শোনা যায়। সেটা হলো মেয়ে শিক্ষিত, চাকুরিজীবী, ডিভোর্স তো হবেই! চাকরি করে বলেই জামাইকে বাদ দিয়ে যেতে পারছে, চাকরির দেমাগে মাটিতে পা পরে না, সংসার করবে কী! ইত্যাদি ইত্যাদি।
হ্যাঁ, মেয়েদের শিক্ষিত হবার হার এবং কর্মক্ষেত্রে পদার্পণ বেড়েছে বলেই ডিভোর্স বেড়েছে। কারণ তারা আত্মসম্মান রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে। এখানে শুধু তাদের কথাই বলছি যাদের পাশে থাকার মানুষটি পাশে নেই। এখন প্রশ্ন হলো চাকরির সাথে ডিভোর্স এর কানেকশন তখনি হয় যখন ওই চাকরিজীবী মেয়েটার সংসার করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সেটা হতে পারে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার, স্বামীর সাথে বোঝাপরা না হওয়া অথবা যেকোনো মানসিক চাপ যেটা সহ্যের বাইরে চলে যায়!
যখন শিক্ষার সাথে সাথে একটা মেয়ে নিজের পরিচয় এবং অর্থ উপার্জন করে নিজে বাঁচার সক্ষমতা রাখে, তখন বসে বসে এসব গলাধঃকরণ করবে, ভাবেন কী করে! তবে চাকরি করেও অনেকে সহ্য করে না তা না। বেরিয়ে আসতে মনের জোরটাও যে চাই! এবার আসি মুখ বুঝে অথবা প্রতিবাদ করে হাজারো স্বপ্নভঙ্গের পরও সংসার করে যাওয়া গৃহিণী যাদের কেউ কেউ শিক্ষিত আবার কেউ কেউ না, তাদের গল্পে। যারা শিক্ষিত হয়েও চাকরির সুযোগ নেই এবং শিক্ষিত না তাদের পদবী শুধুই গৃহিণী।
আমাদের তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থায় তারা বাধ্য হয়ে ওই সকল অত্যাচার সহ্য করে নেয়, কারণ তাদের মাথার উপর সেই ছাদটা নেই যে নিজে আলাদা হয়ে বাঁচবে। না তো শ্বশুরবাড়ি, না তো বাবার বাড়ি। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবার বাড়িতেও শুনতে হবে মানিয়ে নে! তো এখন কী শিক্ষিত চাকুরীজীবী মেয়েরা ডিভোর্স দিবে নাকি তারা দিবে যাদের কোনো উপায় নেই! যুগ যুগ ধরে অবলা হয়ে থাকা নারীরা আসলে নিজের জীবনের সাথে স্যাক্রিফাইস নামক অনেক বড় একটা কম্প্রোমাইজ করে ফেলে! স্যাক্রিফাইস করলে তো মন বড় হয়, কিন্তু জীবনের এই প্রহসন সহ্য করে কম্প্রোমাইজ করলে যে মন মরে যায়!
এডজাস্টমেন্ট একতরফা হয়না, কম্প্রোমাইজও তাই। তবে সেগুলো ছোট ছোট বিষয়ে। কিন্তু যে বিষয়গুলো জীবনকে ধাক্কা দিয়ে যায়, সেগুলোর সাথে বোধহয় কম্প্রোমাইজ করা যায় না। আর যদিও করতে হয়, ওইযে মনকে মেরে আর আত্মসম্মান নর্দমায় ফেলে! সেই নারীরা কখন যে নিজের স্বত্তা হারিয়ে ফেলেন বুঝতেও পারেন না। ধরেই নেন এটাই জীবন। কিন্তু জীবন থেকে অনেক কিছু নেবার আছে তো! চাকরি না থাক, শিক্ষা না থাক, অন্যায়ের প্রতিবাদের এক একটা শব্দও আলাদা শক্তি। সংসার শখে কেউ ভাঙেনা, ব্যতিক্রম নাইবা টানলাম! তাই সব ক্ষেত্রে ভাংচুর করতেই হবে, এমন তো কথা নেই। প্রতিবাদ না করে যতটুকু টিকে থাকা যায়, প্রতিবাদ করে একটু হলেও বেশি টিকে থাকা যায়। আর সেই কলিযুগ পিছনে ফেলে এসেছি আমরা অনেক আগেই। এখন নিজেকে প্রমাণ করার হাজারো পথ খোলা। সবার মধ্যেই কোনো না কোনো গুণ থাকে। আর সেটা কাজে লাগিয়ে যে কেউ নিজের আলাদা পরিচয় তৈরি করে নিতে পারে।
শিক্ষার সার্টিফিকেট নেই আপনার? সেলাই বা হাতের কাজ বা রান্না ভালো পারেন? হয়ে উঠুন উদ্যোক্তা। শিক্ষিত কিন্তু চাকরির সুযোগ হয়নি বা সময় চলে যাবার পর মনে হয়েছে কিছু করবেন? বিভিন্ন সংস্থা আছে আপনার জন্য। অথবা ঘরে বসে টিউশনি। বাঁধা আসবে, আওয়াজ তুলে বেরিয়ে আসুন। ঘর ছেড়ে নয়, প্রতিকূলতা ছেড়ে। আর যদি ঘর ছাড়তে বাধ্য হতেই হয়, নিজের পরিচয় নিশ্চিত করেই বেরিয়ে আসুন। সময়টা এখন আর নাগালের বাইরে নেই। শুধু কাজে লাগিয়ে নিলেই ব্যস! পাছে লোকে কিছু বলবেই! নিজের পরিচয়টাই মাথার উপরে সবচেয়ে বড় আকাশ। যেটা কেউ নিতে পারেনা! কারও মেয়ে বা বউ হয়ে না, নিজের হয়ে বাঁচার প্রশান্তিটাই জীবনকে ভালোবাসতে শেখাবে।
জীবন তখনি সুন্দর যখন প্রতি মুহুর্তে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় নিজের কাজের মধ্যে। আর যাই হোক নিজের অস্তিত্বকে হারিয়ে যেতে না দেই।
(সমাপ্ত )
বলছি একজন বেহায়া মানুষের কথা
আজরিন করিম অহনা
বিয়ের হয়তো তখন ১৮/২০ টা বছর পার হয়ে যায়। স্ত্রীও হয়তো সন্তানের মা হয় আর স্বামী বাবা। ধীরে ধীরে বহুদিন যেতে থাকে। সন্তানেরা বড় হয়। সন্তানেরা বড় হয়ে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে যাওয়া শুরু করে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়। স্বামী হয়তো নানান কাজে সারাদিন ভীষণভাবে ব্যস্ত।
ঠিক এই সময়টায় ধীরে ধীরে স্বামীর তার স্ত্রীর উপর থেকে মন উঠতে শুরু হয়। এ সময় তার স্ত্রীর ভালোবাসা উপেক্ষা করে তখন হয়তো শুধুই স্ত্রীর অসুন্দর রূপটাই স্বামীর চোখে পড়ে।
আর স্বামীরই বা দোষ কি স্ত্রীর যে বয়স বাড়ছে। শরীরের সব সৌন্দর্য ঝরে পড়ছে ধীরে ধীরে, চেহারায় পড়তে শুরু করেছে বয়সের ছাপ, চোখের নিচে পড়ছে কালি। আর সারাদিনের ক্লান্ত শরীর এবং হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করা শরীরে ঘামের গন্ধ হওয়া স্ত্রী কখনও কখনও স্বামীর সাথে ঘুমানোর সঙ্গী হিসেবেও অযোগ্য হয়ে পড়ে।তখন আর স্বামীর স্ত্রীকে ভালো লাগে না। তার তখন চোখ পড়তে থাকে বাইরের হয়তো কোনো সুন্দরী রূপ লাবণ্য ভরা কমবয়সী রমণীর দিকে।
আর সন্তানেরা বড় হয়েছে। তাদের মাকে দেয়ার এতো সময় কোথায়। তাদেরও বাইরে বন্ধুবান্ধব আছে। তাদেরও নতুন বন্ধুবান্ধব নিয়ে দিনকাল বেশ ভালোই যেতে থাকে। আর তাদের কাছে হল মা বড্ড বেশি আনস্মার্ট এক মহিলা যার কিনা বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই।যে কিনা বড্ড বেশি বেমানান তাদের সাথে চলতে। কারণ এই মা যে সামান্য স্মার্টফোনের কাজটাও করতে পারে না । তাদের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় পিক আপলোড দিতে পারেনা। তার ফোনে একটা কোনো সমস্যা হলেও যেন সন্তানকে বলা ছাড়া তার উপায় নেই। তাহলে সন্তানরাই বা কি করে এমন আনস্মার্ট মায়ের সাথে চলবে। তাদের কী এত সময় আছে নাকি মায়ের একটু কথা শুনার জন্য।
কিন্তু ওই যে প্রথমে বললাম এ এক বেহায়া মানুষের কথা । এই মহিলা হলো সেই বেহায়া মানুষ যে স্বামীর অপ্রিয় সে অসুন্দর মুখ নিয়েই রোজ আল্লাহর কাছে তার দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনা করেন। স্বামী অসুস্থ হলে তার সেবা করেন।সারাদিনের হাড়াভাঙ্গা পরিশ্রমে তার শরীরের ব্যথা আর সংসারের চাপে তার হয়তো প্রায়ই নির্ঘুম রাত কাটে । পরদিন চোখের নিচে পড়ে কালি আর তাঁর মুখ রূপ-লাবণ্য হারাতে থাকে । আর এই কারণ হয়তো নিঃসন্দেহে তার স্বামীর অজানা।
এই হল সেই বেহায়া মহিলা যে কিনা তার সন্তানদের কাছে উপেক্ষিত হয়েও তার সন্তান একটু বাড়ি ফিরতে দেরি করলেই ভীষণ চিন্তায় পড়ে যান। আর চিন্তিত হয়েই সন্তানদের ফোন করেন আর সন্তান হয়তো মায়ের ফোন দেখে মাঝে মাঝে চরম বিরক্ত হয়ে যায় এবং মাকে শুনতে হয় “উফফ, মা আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত। প্লিজ ফোন করো না।”
তবু এই মহিলার স্বামী বা সন্তান কারোর প্রতি বিন্দুমাত্র কোন অভিযোগ নেই। মুখে এক চিলতে হাসি রেখেই সহ্য করেন সারাদিনের সমস্ত উপেক্ষা আর ভালোবেসে তার সংসারকে লালন করতে থাকেন নিভৃত যত্নে।
কারণ সংসারের সাথে তার মায়ার বন্ধন।এ বন্ধন হলো এক দীর্ঘকালের বট গাছের শিকড়ের সাথে মাটির বন্ধন।এ বন্ধন হতে বটগাছকে যেমন উপড়ে ফেলা যায় না তেমনি বটগাছ শত প্রতিকুলতা সহ্য করেও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে তার ছায়া তলে স্থান দেয়। তেমনি বটগাছের মত সেই স্ত্রী কিংবা মা কিংবা সে বেহায়া মানুষটিও সংসারের মায়ার বন্ধন উপেক্ষা করে ছেড়ে যেতে পারেনা। বরং নানাভাবে উপেক্ষিত আর অবহেলিত হওয়া সত্ত্বেও স্বামী এবং সন্তানদের দিয়ে যান প্রাণের অবিরাম ভালোবাসা আার যত্ন।
(সমাপ্ত )
আন্তর্জাতিক নারী দিবস
(আপন মনেই গাই)
ডাঃ তামজীদ ফারজানা ফারাহ্
এই যে, ৮ ই মার্চ আসলে সব “নারী দিবস ” বলে, আমাদের “হ্যাপী উইমেন্স ডে “বলে উইশ করেন, একদিনের সম্মান দেখায় কি বিশাল কাজ মনে করেন?
২০২১ সালে এসেও নারী কে মানুষ ভাবতে শিখলো নারে পাগলা… মেয়ে মানুষ নামক আলাদা তকমাই ব্যবহার করে অসম্মান দিয়ে গেলো, সে জাতির কাছে একদিনের সম্মান নিয়ে আমরা কি করব?
আসল কথায় আসি, সেই ছোট মানে গর্ভকালীন মেয়ে না ছেলে বাবু সেখান থেকেই কিন্তু শুরু হয়ে যায় আমাদের আলাদা করা। মেয়ে বাচ্চা কে সবসময় বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয় , কেউ ক্ষতি করে ফেলতে পারে সেই ভয়ে ভয়ে থাকা, বাচ্চাটার শারীরিক গঠন, গায়ের রঙ সকল কিছু নিয়েই সমাজের বিশাল মাথাব্যাথা।
প্রথম দেখায়, ” ওকি মেয়ে দেখি লিকলিকে অথবা দিনকে দিন হাতি হচ্ছিস!”
“কোন চালের ভাত খাও? ” ” রঙ একটু বেশীই ময়লা, এ মেয়ের বিয়ে হবে তো? ” কিংবা কাঁচা হলুদ আর দুধ সারাশরীরে ঘষে দিও এখন থেকেই, পরিষ্কার করবে অনেক টাই” ” যে ধিংগী লম্বু মেয়ে, বর পাবি তো? ( আমি শুনেছি, ছোট তেই লম্বা বেশী হয়েছিলাম)।
“এতো জোড়ে হাসতে নেই মেয়েদের, আস্তে আস্তে হাসতে হয় “( আমার শোনা)
” পা এমন ভাবে ফেলবে যেনো মাটি তে শব্দ না হয়, এতো শব্দ করে মেয়েদের চললে হবে? ( আমার শোনা)
” কানে একটাও দুল নেই, খালি? এমন অলংকার ছাড়া থাকতে নেই। ( আমার শোনা)
আচ্ছা, এইযে কথা গুলি বল্লাম কজন ছেলেদের এমন শুনতে হয়?
হয়না, আমরা ছোট থেকেই প্রচন্ড সমাজের জাজমেন্টের উপর বড় হতে থাকি। চিনি না জানিনা এমন মানুষ ও ছাড়ে না। মজার ব্যাপার, ছেলেদের চেয়ে বড় মহিলারাই এসব বেশী বলেন। অদ্ভুত না? না, অদ্ভুত মোটেও নয়… এভাবেই যে ওরাও শুনে, শিখে বড় হয়েছে। আমি মেয়ে গুলিকে এজন্যই হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়া দেখি, সেইছোট্ট ফ্রক পরা মেয়েটি চুপচাপ, অচেনা হয়ে যায়, সমাজের আড়ালে কাছের সমবয়সী বন্ধুদের মাঝেই বুঝি প্রাণ পায়।
আমাদের করনীয় কি??
কিছুই নয়, মেয়েদের এমন অবস্থায় মায়েদের, বাবাদের হতে হবে ছায়ার মতোন বন্ধু।
স্বাধীন ভাবে ছেলেদের কাজ আর মেয়েদের কাজ না বলে সবার কাজ শিখানো উচিৎ আর নিজেদের পায়ে স্বাবলম্বী হওয়া উচিৎ।
বেতনের কিছু অংশ মায়ের হাতে দিতে আমার ভীষন ভালো লাগে। সেখানে কারো বাধাঁ থাকা উচিৎ নয়, আমরা কারো মা, বোন, বউ, মেয়ে কিন্তু কারো অধীনস্ত নই। আমরা মুক্ত;কিন্তু কই কাউকে তো দেখতে পাইনা আমি মুক্ত?
মায়েদের, শ্বাশুড়ীদের, কর্মজীবি নারী দের, গৃহিনীদের সেই সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত্রি রান্নার যন্ত্রনা থাকেই। বাচ্চা থাকলে তো পোয়া বাড়ো, সারাদিন যায় তাঁদের খেদমত, যত্ন-আত্তি তেই। আর নিজের ঘরের মানুষদের জন্য, মেহমান, আত্বীয়পরিজনদের তুষ্ট করতে করতে সেই মেয়ে যে কখন যন্ত্র মানবে পরিনত হয় সেটা কারো খেয়াল থাকেনা।
“ইশ! গ্যাস হয়ে গেছে, সারাদিন সময় পাইনা খাওয়ার। সন্ধ্যায় গোসল দিয়ে খেতে পারি।”
এসব শুনলে আমার রাগ ও পায়, দুঃখও হয়।
কার জন্য করো হে নারী?
কিসের পাও ‘ বাহবা’।
কিবা সুখ আসে বলো
নিজের শরীর না দেখে চলো!
ওইযে পুরুষ সেতো এসে বসবে খেতে,
করবে সমালোচনা।
রূপ, যৌবন দেখবে বাহিরে,
ঘরে টিকবেনা এককোনা।
হাতি হবে, নয় হাড্ডীস্বাড়,
চামড়া পুড়বে রান্নার জাল।
এ এক মস্ত বড় ফাঁদ রে বাবা,একবার যে ঢুকবে এই গোলকধাঁধায়, আর পারবে না বের হতে।
জীবন কেটে যাবে সোজা গিয়ে কবরে। তাই, সত্যি পুরুষ গুলোকে আগে মেয়েদের সম্মান করা শিখাই আর মেয়ে বাচ্চাদের ও মনে বলিষ্ট বানাই। আর নাকগলানী মহিলাদের বিলীন করে ভস্ম করে দেই। 😄
আবোল তাবোল চিন্তা। ছবিতে আমার সব চেয়ে প্রিয় মানুষ মায়ের সাথে। সব্বাই কে নারী দিবসের শুভেচ্ছা…
কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 🌷🌼🌺💮🌸🕊️
ডাঃ ফারাহ্
৮. ৩.২০২১ রাত্রি ৮ঃ২০
(সমাপ্ত )
Farhana Cynthia, Creative Writer Calgary, Alberta
পাসওয়ার্ড
ফারহানা সিনথিয়া
( সত্য ঘটনার ওপরে ভিত্তি করে লেখা ছোটগল্প )
ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে পারমিতা। বাবা মায়ের সঙ্গে একটা নতুন শহরে কিছুদিন আগেই এসেছে সে। এখনো স্কুলে নতুন কোনো বন্ধু হয়নি।হ্যামিল্টনে ফেলে আসা ওর দুই বান্ধবীর কথা খুব মনে পড়ছে ইদানিং। কৃষ্ণাঙ্গী দুই জমজ বোনের নাম ছিল সিয়েরা আর সুরাইয়া। কোনো একটা বিচিত্র কারণে সুরাইয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব বেশি ছিল পারমিতার।
শরতের সকালে পাতা ঝরার ঘ্রান। আলবার্টা প্রদেশের নতুন শহরে এসেছে অন্টারিও থেকে। অন্টারিওর শরৎকাল আরো সুন্দর হয়।পথের দুইধারে গাছের রং হলুদ, কমলা আর লাল সামিয়ানা হয়ে থাকতো যেন। কোনো কোনো রাস্তায় দেখা যেত হলদে রঙের পাতা পড়ে কি সুন্দর রূপ। এখানে নাকি সেসব হয় না।
বাবা খনিজ সম্পদের একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছেন।এখানে নাকি অক্টোবর মাসে বরফ পড়ে । পারমিতার মন খারাপ হয়েছে শুনে। ওদের হ্যামিলটন শহরের বাড়ি এখনো বিক্রি করেননি বাবা মা। এটা অবশ্য বেশ ভালো ব্যাপার। হয়তো কিছুদিন পরেই আবার ফেরত যাবেন দুজনেই।
বাবা মা দুজনেই সকালবেলা কফি বানিয়ে খুব তাড়াহুড়া করে বের হয়ে যান।নিজের লাঞ্চ নিজেই গুছিয়ে নেয় পারমিতা। সকালে ওকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাবা মা দুজনে অফিসে চলে যান। কোনোদিন বাবা নামিয়ে দেন আর কোনোদিন মা। পারমিতার বয়স তেরো।
মা যেহেতু তথ্য প্রযুক্তি খাতে চাকরি করেন বাবার বদলিতে মায়ের খুব সমস্যা হচ্ছে না। উনি চাইলেই বাড়ি থেকে কাজ করতে পারেন। পারমিতার মা ঝিনুকের যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তার একটা কর্পোরেট অফিস অবশ্য ক্যালগারিতে আছে। ঝিনুক অফিসে গিয়ে কাজ করতেই বেশি স্বাছ্যন্দ বোধ করে। পাঁচটা নাগাদ পারমিতাকে তুলে নিয়ে একবারে বাড়ি ফেরে।
” স্কুল কেমন ছিল আজকে?” ঝিনুক জিজ্ঞেস করলেন।
” এই তো।আজকে একটা কুইজ ছিল।আমি পারফেক্ট স্কোর করেছি।”
” বাহ চমৎকার!আর নতুন বন্ধু?”
” উফফ মা এতো তাড়াতাড়ি বন্ধু হয় না।”
“তুমি কি সুরাইয়া কে মিস কর? আমরা তো সামারের সময় যাব আবার হ্যামিলটন।”
” হুম আমি জানি মম।”
” আমি যখন তোমার বয়সে কানাডা এসেছিলাম আমার সব বন্ধুদের ছেড়ে এসেছিলাম পারমিতা।আমি তোমার সমস্যা বুঝতে পারছি।কিন্তু একটা কথা জানো? চেঞ্জ ইজ দা অনলি কনস্ট্যান্ট।”
এতো ভারী ভারী কথা বোঝে না পারমিতা। শুধু মনে মনে ভাবে যদি তারা আবার হ্যামিল্টনে ফেরত যেতে পারতো খুব ভালো হতো। হাইকিং করে দুই বান্ধবী মিলে আবার এলবিওন ফলস নামের ঝর্ণার কাছে যেতে পারত। প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে নায়াগ্রা ফলসের সৌন্দর্য দেখতে পারত।
বাড়ি ফিরে হাত মুখ ধুয়ে ডিনার করে পারমিতা। পারমিতা পড়াশোনায় খুব ভাল। হোমওয়ার্ক শেষ করে আজকে বাইরের দিকে চেয়ে আছে পারমিতা। রাস্তার স্ট্রিট লাইট জলছে না। বাড়ির উল্টোপাশে একটা বড় গাছ। গাছের নিচে কি কেউ দাঁড়িয়ে আছে ভাবল পারমিতা। ছায়া মতন কি একটা সরে গেল না? পারমিতা আবার চোখ কচলে দেখল। নাহ কেউ নেই।
পারমিতা ঘর থেকে বের হয়ে লিভিং রুমের দিকে গেল। বাবা আর মা কি একটা পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমা দেখছে।কি এক ব্যোমকেশ বক্সী নামের এক গোয়েন্দার সিনেমা। পারমিতা বাংলা ভালোই বোঝে। ভয় কাটানোর জন্য বাবা মায়ের সঙ্গে বসে সিনেমা দেখতে থাকল পারমিতা।
ঝিনুক পারমিতার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঝিনুক বলল,” এই আবির ছেলেটি কিন্তু ভালো অভিনয় করে তাই না শফিক?”
” ভালো অভিনয়! নাকি দেখতেও বেশি ভাল?”
” কি সব বল না তুমি? অভিনয় ভালোই করে।” বলে মুখ টিপে হাসল ঝিনুক।
শফিক দেখল ঝিনুকের আজকে ভালোই আলস্য। মা মেয়ে বেশ দুজনেই আদুরে বেড়ালের ভঙ্গিতে টিভি দেখছে। ফোন হাতে নিয়ে পিজা অর্ডার করল শফিক।
খাওয়া শেষে পারমিতা হোমওয়ার্ক করতে বসল। ওর কানাডিয়ান হিস্ট্রি পড়তে বেশ ভাল লাগে। লেস্টার পেয়ার্সনের ওপর একটা রচনা লিখতে হবে ওটা শেষ করল। কি মনে করে ঘুমানোর আগে আরেকবার জানালা দিয়ে বাইরে দেখল। না কেউ নেই।আজকে আলো জেলেই ঘুমোলো পারমিতা।
—————————————————————————–
অনেক দিন ধরেই ফলো করছে একজন বিকৃত মনের পুরুষ। কিছুদিন আগেই জেল খেটে বের হয়েছে। আগে একটা স্কুলের আশেপাশে চাকরি করত। স্কুলের মাঠের কাছে সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাঘুরি করার জন্য স্কুল থেকে কমপ্লেন করেছিল কিছু ছাত্র ছাত্রী। তখন একবার চাকরি বদল করেছিল।
এরপরে একটু বেশি সাহসী হয়ে গিয়েছিল। অল্পবয়সী ছেলেরা যেখানে বেসবল প্র্যাক্টিস করত সেখানে গিয়ে শিকার খুঁজতে থাকল। পেয়েও গেল এক ছেলেকে। ছেলেটা একটু দুর্বল। জোরে দৌড়ে ওর বন্ধুদের সঙ্গে পারেনা। অনেক সময় মন খারাপ করে নেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকে।
একেবারে আদর্শ শিকার। কিছুদিন গল্প করে ওই ছেলের বিশ্বাস অর্জন করেছিল। ওর পুরোনো নীল রঙের ভ্যানগাড়িতে ছেলেটাকে তুলতে পারলেই হয়। এমনিতেও গাড়িটা সাউন্ড প্রুফ করা। আর কুকুরের শব্দের রেকর্ডিং রেখেছে গাড়িতে যাতে চেঁচালেও শুনতে পাবে না।
সুযোগের সন্ধানে থাকতে থাকতে একদিন পেয়েও গেল সুযোগ। ছেলেটা একদিন প্র্যাক্টিস শেষে কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর ক্লাসের একজন সুঠামদেহী ছেলে ওকে বলেছে এভাবে দৌড়োলে হবে না। ছেলেটার চোখের কোনায় অপমানে পানি চিক চিক করছে। এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে শয়তান লোকটা। বলল,” চলো আমি তোমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিচ্ছি।”
” না ঠিক আছে। আমি একাই যাবো।”
” আহা দেখছি তোমার মন খারাপ।” চলো বলে হাত ধরে টানছিল তখন ওর ক্লাসে পড়া একটা ষণ্ডা মতন ছেলে এসে বলল,” হেই মিস্টার তুমি কি চাও? এখানে কি?”
আরো কয়েকজন জড় হয়ে গেল। পুলিশ ডাকতেই ঝামেলা হল। পুলিশ আসার আগে দৌড়ে পালালেও ছেলেগুলো ওর গাড়ির লাইসেন্স প্লেটের ছবি তুলে দিয়ে দিল। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে বাড়ি এল। এরপরেই দোকানের ক্যাশ রেজিস্টার থেকে চুরি করে ধরা পড়ল। এবার জেল থেকে বেরিয়ে একটু মরিয়া। নতুন শিকার পেয়েছে। অনেকদিন ধরেই লক্ষ্য করছে।
মেয়েটা অন্যদেশী। এখানে নতুন এসেছে। প্রতিদিন লক্ষ্য করে বাবা মা নামিয়ে দিয়ে যায় স্কুলে আর তুলেও নিয়ে আসে। ও প্রতিদিন মেয়েটিকে অনুসরণ করে নীল রঙের ভ্যানগাড়িতে। একবার গাড়িতে তুলতে পারলেই হবে ভাবে মনে মনে।
নাহ এই মেয়েকে কিছুতেই হাতের নাগালে পাওয়া যাচ্ছে না ভাবল লোকটা। একদিন ওদের চিঠি চুরি করল সামনের পোর্চ থেকে। মেয়েটার বাবা আর মায়ের নাম পাওয়া গেছে। তক্কে তক্কে থাকল শয়তানটা।
———————————————————–
শফিকের আজকে অফিসের পরে একটা জরুরি মিটিং পড়েছে। ঝিনুক নিজেও বেশ ব্যস্ত। অনেক্ষন ধরেই ফোন বাজছে ঝিনুক আর শফিক কেউই ফোন ধরতে পারছে না। ফোন করেছেন পারমিতার স্কুলের প্রিন্সিপাল মিস জেঙ্কিন্স।ঠিক সাড়ে তিনটা নাগাদ প্রিন্সিপাল মিসেস জেনকিন্সের অফিসে ডাক পড়ল পারমিতার।
” পারমিতা একজন ভদ্রলোক এসে বলছেন তোমার বাবা মা নাকি এক্সিডেন্ট করেছেন। এই ভদ্রলোক নাকি তোমাকে নিতে এসেছেন। উনি তোমার বাবার অফিসে চাকরি করেন। তোমার ইমার্জেন্সি কন্টাক্টে ওনার নাম লেখা নেই।তুমি কি ওনাকে চেন?”
পারমিতা সামনে বসা লোকটিকে দেখল,” আমি তোমাকে ঠিক চিনতে পারছি না।”
” আমি তোমার বাবার কলিগ। উনি বলেছেন তোমরা শহরে নতুন। তোমার বাবা মা আজকে দুজনে এক সঙ্গে বেড়িয়েছেন। তাই না? একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
পারমিতা বলল,” মিস জেঙ্কিন্স আমার বাবা মা একটা পাসওয়ার্ড সেট করেছেন আমার সঙ্গে। উনি যদি সঠিক পাসওয়ার্ড বলতে পারেন তবে আমি ওনার সঙ্গে যাব। আপনি বলুন তো আমার বাবা মায়ের কোন শহরে দেখা হয়েছিল।”
লোকটা এখন আমতা আমতা করছে। পারমিতা ঘুরে বলল,” মিস জেঙ্কিন্স আপনি আমার বাবা মাকে আবার ফোন করুন। এই লোকের সঙ্গে আমি যাবো না।”
মিস জেঙ্কিন্স বললেন,” আমি দুঃখিত। আপনি পাশের রুমে অপেক্ষা করুন।”
ধূর্ত লোকটার দিকে নজর রাখতে বলবেন ভেবে মিস জেঙ্কিন্স আরেকজন টিচারকে ডাকলেন। প্রিন্সিপালের রুম থেকে বের হয়েই লোকটা দেয়াল টপকে পেছন থেকে পালিয়ে গেল।
পারমিতার মাকে কিছুক্ষনের মধ্যেই ফোনে পাওয়া গেল।উনি নিশ্চিত করলেন এমন কাউকে ওনারা পাঠাননি। ওনাদের দুজনের সঙ্গে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।
মিস জেঙ্কিন্স বারবার বলছেন,” জিযাস! কি হতে যাচ্ছিল আজকে। থ্যাংক ইউ পারমিতা। তোমার বাবা মায়ের সঙ্গে ঠিক করে রাখা পাসওয়ার্ড আমাদেরকে বাঁচিয়ে দিল।”
শফিক আর ঝিনুক স্কুলে নিতে আসল দুজনেই। এরপরে সোজা পুলিশ স্টেশন। পুলিশ স্টেশনের স্কেচ আর্টিস্ট খুব মনোযোগ দিয়ে লোকটির স্কেচ আঁকতে শুরু করল। সেই স্কেচের কপি আশেপাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে টাঙিয়ে দিল।
এর ঠিক দুইদিনের মাথায় একজন পুলিশ স্টেশনে আবার ফোন করল। একটা ডে কেয়ারের পাশে নাকি সন্দেহজনক ভঙ্গিতে ছবি তোলা অবস্থায় একজনকে ধরেছে ডে কেয়ার সেন্টারের মালিক ভদ্রমহিলা। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছুতেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসল। স্টেশনে ঢুকেই অফিসার জনসন তার পার্টনারকে বললেন,” তোমার মনে আছে দুইদিন আগে এক অভিবাসী পরিবার এসেছিল? দেখো তো স্কেচের সঙ্গে মিল পাও কিনা?”
জিম প্যাটিসন বলল,” এর তো চুরির রেকর্ড আছে। নাম ধাম টাইপ করতেই চলে এল।”
পরদিন মিস জেঙ্কিন্স আর পারমিতা ওকে সেদিনের অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করল।
পুলিশ অফিসার দুজন ওর নামে চার্জ ফাইল করলেন। পারমিতার বাবা মাকে বললেন,” থ্যাঙ্ক ইউ বোথ ফর হ্যাভিং এ পাসওয়ার্ড উইথ ইওর ডটার।”
(সমাপ্ত )